পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত এবং বাংলাদেশের প্রধান পর্যটন জেলা কক্সবাজার।১২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ বিশিষ্ট এই সমুদ্র সৈকতের বৈশিষ্ট হল পুরো সমুদ্র সৈকতটি বালুকাময় যেখানে কাদার কোন অস্তিত্ব নেই।১৭৯৯ সালে আরাকানি বাস্তুতের পুনর্বাসনের জন্য ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়।এই কক্স সাহেব এখানেই এসেই একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং তাঁর নাম অনুসারেই পর্বতিতে এই বাজারের নাম অনুকরন করা হয় কক্সবাজার।প্রাকৃতিক সৌন্দয্য মন্ডিত এই জেলার প্রায় অর্ধেক এলাকা জুড়ে পার্বত্য অঞ্চল এবং অর্ধেক সমুদ্র উপকুলীয় দ্বীপাঞ্চল।জেলার প্রাধান দ্বীপ সমূহ হচ্ছে মহেশখালী,কুতুবদিয়া,মাতারবাড়ি,সোনাদিয়া,শাহা পরীর দ্বীপ এবং সেন্টমার্টিন দ্বীপ।আমরা গেলাম কক্সবাজার থেকে ৮৬ কিলোমিটার দক্ষিণে টেকনাফ উপজেলায়।দেখলাম টেকনাফের পুলিশ ফাড়ির চত্ত্বরে রয়েছে ঐতিহাসিক মাথিরের কূপ।এখানে এসে আমরা জানতে পারলাম যে ধীরাজ ভট্টাচার্যের সঙ্গে টেকনাফের জমিদার কন্যা মাথিরের নিবিড় প্রেমের সাক্ষী হয়ে আছে এই কূপ।আমরা জাহাজে চড়ে গেলাম বাংলাদেশের একমাত্র এই সামুদ্রিক প্রবল দ্বীপ হচ্ছে কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন দ্বীপ।বালুকাময় সৈকত,সুনীল জলরাশি আর সারি সারি নারিকেল গাছের অপর লীলা ভূমি এই সেন্টমার্টিন দ্বীপ।কোন ভাবেই যেন মন যেতে চাইছে না এখান থেকে।পরের দিন আবার রওনা হলাম কক্সবাজারের আরেকটি উল্লেখ যোগ্য স্থান রামুতে।এখানে রয়েছে বেশকিছু পত্নত্তাত্বিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শন।রামু উপজেলার জুয়ারিয়ানলা ইউনিয়নে উত্তর মিঠাছড়ি গ্রামে তৈরী করা হয়েছে ১০০ ফুট লম্বা দেশের সবচেয়ে বড় গৌতমবুদ্ধের সিংহ সজ্জা বুদ্ধ মুর্তি।
 |
কক্সবাজার |
পাহাড়-সমুদ্র ও ঝর্ণা নিয়ে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আরেকটি স্থান হচ্ছে কক্সবাজারের হিমছড়ি।হিমছড়ির পরেই আমাদের বা পর্যটকদের অত্যন্ত আকর্ষনীয় নাম ইনানী। এখানে উপভোগ করলাম বিস্তির্ন পাথরের সৈকত।কক্সবাজারের শুধু সমুদ্র স্নান বা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগই নয়।সমুদ্র তলের প্রাণীদের সম্পর্কে ধারনা দিতে সম্প্রতি বেসরকারী উদ্দ্যোগে এখানে গড়ে উঠেছে একটি ফিস একোরিয়াম।কক্সবাজারের ঝাউতলে স্থাপিত এই একোরিয়ামে রয়েছে লোনা ও মিঠা পানির প্রায় শতাধিক দুর্লভ ও বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ।যা দেখার জন্যে প্রতিদিন আমাদের মত হাজার হাজার দর্শনার্থী এই রেডিয়েন্ট ফিস একোরিয়ামে।আমরা জানতে পারলাম এই গত ৩০ নভেম্বর ২০১৭ দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।কিছু ক্ষণ পরে আমরা আরো দেখতে পেলাম কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন রেজুখালী এলাকায় পর্যটকদের জন্যে বিশেষ করে শিশু-কিশোর ও শিক্ষার্থীদের জন্য বেসকারী উদ্দ্যোগে সাম্প্রতি এই অক্টোবর ২০১৭ মাসেই শুরু হয়েছে হাতি ও মানুষের অভিনয় সমৃদ্ধ একটি চমৎকার শিক্ষামুলক অনুষ্ঠান ।যার নাম দেয়া হয়ছে সেইফ এলিফ্যান্ট থিয়েটার।আমাদের জীব ও বৈচিত্র টিকিয়ে রাখতে হাতি সংরক্ষনের বিকল্প নেই।তাই হাতি সংরক্ষনে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং হাতি ও মানুষের দ্বন্দ-সংঘাত নিরসনে বিনোদনের পাশা-পাশি একটি চমৎকার শিক্ষামুলক থিয়েটারের উদ্দ্যোগ ।
আমরা সমুদ্র সৈকতে বেশি উপল্বদ্ধি করলাম জোয়ারের পানিতে সাগর থেকে তীরে ভেসে আসে অসংক্ষ শামুক ও ঝিনুক।এছাড়াও আমরা দেখলাম নানান প্রজাতির প্রবল সমৃদ্ধ বিপণী-বিতান এবং কথিত বার্মিজ মার্কেট সমূহে আমাদের মত শত শত পর্যটকদের বিচরনে এই কক্সবাজার শহরে পর্যটক মৌসুমে এই অসাধারন প্রাণ চাঞ্চল্য দেখা যায়।আমরা দেখলাম মায়াবি এই সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য বিচ পুলিশ সংযোজন একটি অসাধারন উদ্দ্যোগ।
আমরা পরদিন রওনা হলাম শুটকি পল্লীর উদ্দেশে।আমাদের দেশের সামুদ্রিক শুটকির একটি বড় অংশ তৈরী হয় এই কক্সবাজারে।বিশেষ করে শীত মৌসুম এলে কক্সবাজারে রনাজারেরটেক,মহেশখালীর সোনাদিয়া এবং কুতুবদিয়া সহ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের শুটকি মহলগুলো যেন প্রাণ ফিরে পায়।আমাদের দেশের এই উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ৭দশমিক৩ মিলিয়ন মানুষ প্রতক্ষ্য বা পরক্ষ্যভাবে এই সামুদ্রিকমৎস্য আহরন এবং তা প্রক্রিয়াজাতকরনের সাথে জড়িত থেকে জীবিকা নির্বাহ করে।আমরা এসেছি কুতুবদিয়ার অমজাখালীর একটি ছোট শুটকি পল্লীতে।আমরা কিছু স্থানীয় মানুষের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম এখানে লটেমাছ,ছুরিমাছ,চিংড়ি সহ নানান প্রজাতির মাছ বঙ্গোপসাগর থেকে ধরে শুকাতে দেয়া হয়।মাছধরে এটা শুটকিমাছে পরিনিত করতে ৩/৪ দিন লাগে।১৫ দিন পর পর ট্রলার ,জাহাজে করে মাছ আনা হয়।এই ১৫ দিনের মাছ ১৩ থেকে ১৬ লাখ টাকা বক্রিয় করা হয়।আমরা আরো জানতে পারলাম এখান থেকে দেশের প্রায় ৮০শতাংশ শুটকি এখান থেকে উৎপাদন করা হয়।এখানে শুধু দেখা যায় শুটিকমাছের মাচা আর মাচা । নারী-পুরুষ ,ছেলে-মেয়ে সবাই এই পেশায় জড়িত।
 |
শুটকি পল্লী |
আমরা এর পর গেলাম নাজেরাটেক মাছ ঘাটে।এখান দেখতে পেলাম বেশ কিছু মাছের বড় বড় ট্রলার।সমুদ্র থেকে মাছ ধরে ট্রলারে করে আনা হচ্ছে।ঠেলা গাড়িতে করে মাছ নিয়ে যাচ্ছে ।এবং এই মাছ থেকে শুটকি তৈরী করা হয়।আমরা আরো জানতে পারলাম এখানে প্রায় ৬০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন।প্রতি সপ্তাহে ৪০০ টন মাছ এখান থেকে চট্টগ্রামে পাঠানো হয়।আমাদের মত শত শত পর্যটক এখানে প্রতি নিয়ত আসে।
আমরা এর পরে আসলাম কুতুবদিয়াতে।কক্সবাজারের অত্যন্ত প্রাচীন ও ঐতিহাসিক দ্বীপ হচ্ছে এই কুতুবদিয়া।এর আয়তন ২১৫.৮ বর্গ কিলোমিটার।১৯১৭ সালে প্রথম এই থানা স্থাপিত হয়।এবং ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে এই থানার ১০০ বছর পূর্তি হয়।এখানে দেখে আমাদের আর বুঝতে বাকি রইল না যে এই কুতুবদিয়া লবণ উতপাদনের জন্য বিখ্যাত। এবং এই জন্যেই এই শীতে মাঠে মাঠে কৃষকদের কর্ম ব্যস্ততা দেখা যায়।আমরা দেখতে পেলাম ছোট ছোট খালের মত ,যা থেকে সাগর থেকে পানি এনে লবণ আহরণ করা হয়।অনেক বেশি ভাল লাগল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেখে।এটা এই কুতুবদিয়াতেই অবস্থিত।বিশাল আকৃতির ঘুর্নায়মান পাখা আমাদের মত সকল পর্যটকদের নজর কাড়ে।এর আমরা দেখালাম কুতুবদিয়া বাতি ঘর।এখন যে বাতি ঘরটি আছে সেটি হল লোহা নির্মিত। ১৮৪৬ সালে প্রথম বাতি ঘর স্থাপিত হয়। গভীর সমুদ্রে সংকেত দেয়ার জন্যে সে সময় ব্রিটিশ সরকার বেশ কয়েকটি বাতি ঘর স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়।এবং সেই অনুযায়ী প্রথম বাতি ঘরটি এই কুতুবদিয়াতে স্থাপিত হয়।আমরা আরো জানতে পারি যে এই বাতি ঘরের বিচ্ছরিত আলো ২৫ থেকে ৩৫ কিলোমিটার গভীর সমুদ্র থেকে দেখা যায়।নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারনে পুরানো বাতি ঘরটি সমুদ্রে নিচ্ছিন্ন হওয়ায় ১৯৭২ সালে এই লোহার সুউচ্চ বাতি ঘরটি নির্মাণ করা হয়।যা প্রাচীন বাতি ঘরকে স্মৃতি হিসাবে রেখেছে।।সতিই অপরূপ এই কক্সবাজার।কে জানি মন যেন যেতে চাইছে না এখান থেকে।
Post a Comment